শেখ মোস্তফা কামাল, কেশবপুর যশোর প্রতিনিধি : শীতের আগমনের সাথে সাথে গ্রাম-বাংলার ঐতিহ্য খেজুর রস সংগ্রহে ব্যস্ত সময় পার করছে যশোরের কেশবপুর উপজেলার কাস্তা ভাল্লকঘর, মূলগ্রাম, বেলকাটি, সাগড়দাড়ি, ফতেপুর, চিংড়া, হাসানপুর, ধর্মপুর, আওয়ালগাতি, ভান্ডারখােলা, দেউলি, বাগদাহ, সাবদিয়া, মজিদপুর, মধ্যকুল, ব্ৰহ্মকাটি, রামচন্দ্রপুর, ব্যাসডাঙ্গা, পাঁজিয়া, গড়ভাঙ্গা, কলাগাছি, গৌরিঘােনা, ভেরচি, মাগুরখালি, মঙ্গলকোট, বড়েঙ্গা, কন্দর্পপুর, পাথরা, কেদারপুরসহ অনেক গ্রামে ঘুরে দেখা গেছে গাছিরা খেজুরের রস সংগ্রহের জন্য প্রয়ােজনীয় উপকরণ যেমন ঠিলে-খুংগি-দড়া- গাছি দাঁ বালিধাসহ ইত্যাদি নিয়ে গাছ কাঁটার কাজে ব্যস্ত রয়েছে।

গ্রাম অঞ্চলের গাছিরা গ্রামের পরিত্যাক্ত জায়গা ও আকা-বাকা পথের পাশে ডােবা-পুকুর পাড়ে সারি সারি অপরিচ্ছিন্ন খেজুর গাছ গুলাের পুরানাে ডাল পালা কেটে পরিষ্কারের কাজ সম্পন্ন হয়েছে এবং অনেক গাছের পরিচর্যা চলছে।

জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে উপকূল এলাকার মৌসুম গুলি কিছু দেরিতে শুরু হয়। যশোরের কেশবপুর উপজেলার সহ বেশ কয়েকটি উপজেলা ঘুরে সরেজমিনে দেখা গেছে শীতের তীব্রতা দেখা না দিলেও এরই মধ্যে অনেক গাছি খেজুর রস সংগ্রহের কাজ শুরু করে দিয়েছেন। গ্রামীণ জীবনে শীত এ অঞ্চলের গাছিদের কাছে বিভিন্ন মাত্রায় রূপ নিয়ে আসে।

নানা স্বপ্ন আর প্রত্যাশায় তাদের অনেকটা সময় কেটে যায় এই খেজুর গাছের সাথে। সারাদিন এক গাছ থেকে অন্য গাছ এভাবেই তাদের দিন কেটে যায়। গাছির জীবন সংগ্রামে বহু কষ্টের মাঝে অনেক প্রাপ্তিই মিটে যায় গ্রাম বাংলার এই জনপ্রিয় বৃক্ষ খেজুর রস আহরণের সাথে। গাছিদের কাছে এই সময়টা হয় অনেক আনন্দের। গাছ কাটার জন্য গাছের মাথার এক দিকের ডাল কেটে পরিষ্কার করা হয়।

আর কাটা অংশের ঠিক মাঝ বরাবর নিচে দুটি ভাজ কাটা হয়। সে ভাজ থেকে কয়েক ইঞ্চি নিচে একটি সরু পথ বের করা হয়।

এই সরু পথের নিচে বাঁশের তৈরি নালা বসানাে হয়। এই নালা বেয়ে চুয়ে | চুয়ে পাত্রে রস পড়ে। সাধারণত দুপুরে গাছে ভাড় বেঁধে রাখা হয়, সারা রাতে রস পাত্রে পড়তে থাকে। এসময় শালিক, দোয়েলসহ বিভিন্ন ধরনের পাখিরা গাছে ভিড় করে রস খাওয়ার জন্য।

গাছ কাটার পর দুই দিন রস পাওয়া যায়। প্রথম দিনের রস পাটালি গুড় তৈরী হয়, আর দ্বিতীয় দিনের রসে ঝােলা গুড় তৈরী হয়। রসের জন্য খেজুর গাছে একবার কাটার পর পাঁচ-ছয় দিন পর কাটা হয়। গাছের কাটা অংশ শুকানাের জন্য এসময় দেওয়া প্রয়ােজন।

খেজুর গাছ কাটা অংশ শুকানাের সুবিধার জন্যই সাধারণত পূর্ব ও পশ্চিম দিকে গাছ কাটা হয়। যাতে সূর্যের আলাে সরাসরি কাটা অংশে পড়ে। ভােরের হাড় কাপানাে ঠান্ডায় গাছ থেকে রসের পাত্র নামিয়ে হিমশীতল খেজুর রস খাওয়ার স্বাদটাই মধুর।

ভাের বেলায় রস খেলে শীত মনে হয় আরাে বেশি জেকে বসে। শীত লাগে লাগুক তবুও রস খাওয়ার চাই। যতই শীত লাগুক না কেনাে রস খেতেই হবে। তারপর রােদ পােহানাে আনন্দের অনুভূতি অন্যরকম। ভােরে গ্রামের ছেলে-মেয়েরা রােদ পােহানাের সাথে অপেক্ষায় থাকে কখন গাছ থেকে নামানাে হবে খেজুরের সু-মিষ্টি রস। যশোরের কেশবপুর উপজেলার মিজ্জানগন গ্রামের গাছি মো নূর আলী বিশ্বাস বলেন, খেজুর গাছ প্রায় ছয়/সাত বছর বয়স থেকে রস সংগ্রহ

করা যায়, আর পঁচিশ থেকে ত্রিশ বছর বয়স পর্যন্ত গাছ থেকে রস পাওয়া যায়। তবে গাছ যতই পুরনাে হয় রস দেয়া ততই কমে
যায়। পুরনাে গাছ রস কম দিলেও পুরনাে গাছের রসগুলাে খুবই মিষ্টি ও সুস্বাদু হয়।

মাঝ বয়সের গাছ থেকে সবচেয়ে বেশি পরিমাণ | রস পাওয়া যায়। বেশি রস সংগ্রহ করা গাছের জন্য অবার অনেক ক্ষতিকর। তবে তারা জানায়, নতুন করে তেমন কেউ গাছির কাজ | করতে আগ্রহী না হওয়ায় অনেক খেজুর গাছ পরিত্যাক্ত থেকে যাচ্ছে। সে জন্য সব গাছ থেকে রস বের করা সম্ভব হচ্ছে না।

গাছিরা দিনের বেশির ভাগ সময় কাটান খেজুর গাছে। যেন মাটিতে পা ফেলার ফুসরত নেই। শীত আসা মাত্রই খেজুর গাছ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে তােলার জন্য অনেক আগে থেকেই সকাল-সন্ধ্যায় যেন লেগে থাকে গাছিরা। খেজুর গাছ বিশেষ কায়দায় কাটতে হয়।

গাছিরা বিভিন্ন উপকরণের সমন্বয়ে খেজুর গাছ পরিচ্ছন্ন ভাবে কাটার জন্য ব্যস্ত থাকেন। তারা গাছ কাটতে ব্যবহার করেন লােহা তৈরি ধারালাে দা, মােটা দড়ি, দা রাখার জন্য বাঁশ বা প্লাস্টিক দিয়ে তৈরি থলি। যা গাছির কমড়ে রশি দিয়ে বেধে গাছে উঠা নামা করে।

গাছ কাটার জন্য গাছি শরীরের ভারসাম্য রক্ষার জন্য কোমর বরাবর গাছের সঙ্গে দড়ি দিয়ে বেঁধে নেয়। দড়িটা বিশেষ ভাবে তৈরি করা হয়। এই দড়ির দুই মাথায় বিশেষ কায়দায় গিট দেওয়া থাকে। গাছে উঠার পর অতি সহজে গিট দুটি জুড়ে দিতে হয়। অনেকে আবার গাছের মাথায় দাড়ানাের জন্য শক্ত কাঠ বা বাঁশ রশি দিয়ে গাছের সঙ্গে বেঁধে দেয়।

এতে গাছি নিরাপদে গাছ কাটাতে পারে। রস নামানাের পর জাল দিয়ে গুড় তৈরি করা হয়। যা পাটালি গুড় ও ঝােলা গুড় বলা হয়। এ সব গুড় বিভিন্ন ভাবে খাওয়া হয়।

শীতে খেজুর গাছের রস হতে যে গুড়ে তৈরি করা হয় তা দিয়ে দুধের পিঠা, পায়েস পুলি পিঠা তৈরি করে খাওয়ায়। তবে খেজুরের রস দিয়ে তৈরি রসের পিঠা খুবই সুস্বাদু হয়ে থাকে। আর খেজুর গুড়ের সন্দেশের স্বাদ হয় অপূর্ব। বলতে গেলে একবার খেলে স্বাদ সারাজীবন যেন মুখে লেগে থাকে। গাছ থেকে রস সংগ্রহের জন্য সাধারণত মাটির হাড়ি ব্যবহার করা হয়।

আগের মতো খেজুর গাছ এখন আর নেই। ইটভাটায় খেজুর গাছ পোড়ানো, জলাবদ্ধতাসহ নানা কারণে গাছের সংখ্যা কমে গেছে। সে কারণে খেজুরের রস ও গুড় এখন প্রায় বিলুপ্তির পথে। পেশাদার গাছির সংখ্যাও কমে গেছে।তাই প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার জোর দাবি জানিয়েছে সরকারের কাছে